
নিজস্ব প্রতিবেদক
২১ মে, ২০২২, 10:47 AM

প্রাণিখাদ্যের দাম বাড়ায় খামারিরা বিপাকে
সালটা ২০১৭। মাহমুদ হাসান ঢাকার কেরানীগঞ্জের তারানগরে পাঁচ একর জমিতে শুরু করেছিলেন পোলট্রি খামার। শুরুতে মুরগি ছিল ১০ হাজার। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর ব্যবসার পরিধি। মুরগির খাবারের এখনকার আকাশছোঁয়া দামের সঙ্গে টিকতে না পেরে মাসখানেক আগে গুটান ব্যবসা। মাহমুদের আক্ষেপ, খামারিদের দেখার কেউ নেই। সুদিনের আশায় গেল ছয় মাস লোকসান গুনেছি। ঋণের বোঝা ভারী হয়ে যাওয়ায় আর ব্যবসা ধরে রাখতে পারিনি। পাবনার ফরিদপুরের দুগ্ধ উৎপাদন প্রধান এলাকা রতনপুর গ্রামের আলহাজ আলী। গরুর খামারের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন সেই কৈশোর থেকে। তাঁর খামারে ছিল ৩০টি গরু। গত এপ্রিলে গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারের অর্ধেকের বেশি গরু বেচে দেন। কোরবানির ঈদ ঘিরে গরু মোটাতাজা করতে যে খাবার দরকার, তা তিনি জোগান দিতে পারছেন না।
মাহমুদ হাসান আর আলহাজ আলীর মতো একই দশা দেশের নানা প্রান্তের খামারিদের। পশুখাদ্যের টানা দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এ খাতের উদ্যোক্তারা পড়েছেন মহাদুর্বিপাকে। তাঁরা জানিয়েছেন, গত তিন মাসে প্রাণিজ খাদ্য, ওষুধ, ভ্যাকসিনসহ প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা এখন দিশেহারা। একই পরিস্থিতি প্রাণিজ খাদ্য বিক্রেতাদেরও। তাঁরা বলছেন, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সয়ামিল রপ্তানি চালু রাখা ও গম আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে কাঁচামালের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তাঁদের আশঙ্কা, কাঁচামালের দর সমন্বয় করা না গেলে দেশের ফিড মিলগুলো যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে হুমকিতে পড়বে মৎস্য ও প্রাণী খাত। ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ফলে হুমকির মুখে পড়বে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা।
কাঁচামালের দাম লাগামহীন :বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) তথ্য বলছে, গত দুই বছরে সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। অন্য কাঁচামালের দাম বেড়েছে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে কাঁচামালসহ মোট উৎপাদন খরচ এতটাই বাড়ন্ত, প্রতি কেজি ব্রয়লার ফিডে ৩-৪ টাকা, লেয়ার ফিডে ২.৫-৩.৫ টাকা, ক্যাটেল ফিডে ৩.৫-৪ টাকা, ডুবন্ত ফিশ ফিডে ২.৫-৩.৫ টাকা এবং ভাসমান ফিশ ফিডে ৪-৫ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। কাঁচামালের দাম বাড়ায় বড় ফিড মিলগুলো তাদের উৎপাদন ১৫-২০ শতাংশ কমিয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে ভুট্টার কেজি ছিল ২৪.১৭ টাকা, এই মে মাসে তা হয়েছে ৩৫ টাকা। ৩৭.২৫ টাকার সয়াবিন মিলের দাম এখন ৭০ টাকা। ৩৮.৫০ টাকার ফুল ফ্যাট সয়াবিনের দাম হয়েছে ৭৬ টাকা। ২১.২৫ টাকার রাইস পলিস কিনতে হচ্ছে ৩৬.৩৩ টাকায়। ১৩৩.৩৩ টাকার এল-লাইসিন ২৫০ টাকা, ২০০ টাকার ডিএলএম ৩৩০ টাকা, ৫৪ টাকার পোলট্রি মিল ১১০ টাকা এবং ১০০ টাকার ফিশ মিল কিনতে হচ্ছে ১৫০ টাকায়। ফিড তৈরিতে ৫০-৫৫ শতাংশ ভুট্টা এবং ৩০-৩৫ শতাংশ সয়ামিলের দরকার হয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়ামিলের দাম ৩০ শতাংশ এবং ভুট্টার দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে। গত আগস্টে সয়ামিলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, এই মার্চে হয়েছে ৭০ টাকা। বর্তমানে বাজারে সয়ামিল ৬৬ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। গত ১১ মার্চ ব্রয়লার মুরগির ফিডের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৭ টাকা, গত ১৭ মে তা হয়েছে ৬৩ টাকা। সয়ামিল রপ্তানি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত :চার মাস রপ্তানি বন্ধ থাকার পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ফের সয়ামিল রপ্তানি সুবিধা দেওয়ার কারণে এ খাতের উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে, ভারত হঠাৎ সয়ামিল আমদানি শুরু করলে বেশ কিছু দেশীয় উৎপাদনকারী লাভের আশায় ঝুঁকছে রপ্তানির দিকে। এতে সয়ামিলের দাম আরও চড়েছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, বর্তমানে দেশের চাহিদা মেটাতে সয়ামিল দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন সয়ামিলের চাহিদা রয়েছে। এর ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ দেশেই উৎপাদন হয়। বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রধান উপকরণ সয়ামিলের 'কৃত্রিম সংকট' সৃষ্টির অভিযোগ তুলে মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দেশের সয়ামিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ক্কমুক্তভাবে সয়াবিন বীজ আমদানি করে। সেখান থেকে সয়াবিন তেল উৎপাদনের পাশাপাশি উপজাত হিসেবে পাওয়া সয়ামিল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। দেশের মানুষের স্বার্থে শূন্য শুল্ক্ক সুবিধায় আনা সয়াবিন বীজ থেকে উৎপাদিত সয়ামিল তিন থেকে চারটি সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি বেশি মুনাফার লোভে রপ্তানি করে দিচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বর্তমানে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের কথা কেউ শুনছে না। খামারিদের উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। প্রকল্পের পর প্রকল্প চলছে, খামারিদের দুঃখ দূর হচ্ছে না। পশুখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বন্ধ হচ্ছে ফিড মিল :প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও ভুট্টার জোগান কম থাকায় সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের মিরাজ ফিড মিল। এই ছবি শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের নয়, দেশের অন্তত অর্ধশত ফিড মিলের চাকা আর ঘুরছে না। কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় থমকে যাচ্ছে প্রাণিখাদ্য উৎপাদন। পোলট্রি শিল্প সেন্ট্রাল কাউন্সিলের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ফিড মিল বন্ধ হয়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে তাদের কেজিতে লোকসান হচ্ছে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ অঞ্জন বলেন, এ খাতের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। প্রধান কাঁচামাল সয়ামিল ও ভুট্টার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ডলারের দাম বাড়ায় পশুখাদ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক বছর আগেও প্রতি কেজি সয়ামিল পাওয়া যেত ২০-২২ টাকায়, এখন তা বেড়ে ৬৬ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। বিশ্ববাজারে ভুট্টার দাম ৪০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১২০ ডলার।
বন্ধ হাজার হাজার পোলট্রি খামার :প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা ৯০ হাজার। তবে সারাদেশে রয়েছে এক লাখেরও বেশি হাঁস-মুরগির খামার। বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) বলছে, লোকসানে ব্যবসা টানতে না পেরে ৪০ শতাংশেরও বেশি খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। সংকটের ব্যাখ্যা দিয়ে বিপিআইসিসির সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, করোনার দেড় বছরে পোলট্রি সেক্টর একটি বড়সড় ধাক্কা খায়। এখান থেকে উঠে আসতে বেগ পেতে হয়েছে। এখন আবার প্রাণিজ খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে হাজার হাজার খামারি তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যাচ্ছেন। দেশীয় শিল্প রক্ষাসহ পুষ্টিকর খাদ্য ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন সচল রাখতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধার দাবি করেন তিনি। এদিকে, সয়ামিল রপ্তানি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। তবে তা এখনও আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে লাখ লাখ খামারি পশু পালনে ঝুঁকেছেন। গো-খাদ্যের উচ্চ দরের কারণে কোরবানির পশুর দাম বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, কোরবানি ঈদের আর বেশি দিন নেই। আমার মনে হয় না এই অল্প সময়ের মধ্যে পশুর বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, কেউ যদি পশুখাদ্য উৎপাদনে কারখানা করার যন্ত্রপাতি আনতে চায়, সে ক্ষেত্রে উৎসে কর মওকুফ করার ব্যাপারটি বিবেচনায় নেওয়া হবে। শুধু সয়ামিল বা এ জাতীয় খাদ্যের ওপর নির্ভর না করে গরুর খামারিদের খামারের পাশে ঘাস চাষেও গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, সয়ামিল রপ্তানি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলাম। বাণিজ্যমন্ত্রী আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এটা যাতে বাইরে না যায়, সেটার ব্যবস্থা করবেন। নতুন করে চিঠি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা মনে করি, আবেদনটা এখনও বিবেচনাধীন। সূত্র: সমকাল