
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৫ জুন, ২০২৫, 11:02 AM

কঠিন হয়ে পড়ছে বাজেট বাস্তবায়ন
বাজেট বাস্তবায়নে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় অংশের জোগান আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে। এ জন্য প্রতিবছর বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়, তা কখনোই পূরণ বা অর্জন করতে পারে না এনবিআর। এমনকি লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করার পরও তা পূরণ হয় না। প্রতিবছরই বিশাল ঘাটতি থাকে। এর প্রধান কারণ, প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা সব সময় উচ্চাভিলাষী। অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির যে আকার, সে অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি আদায় করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিবছরই লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকে এনবিআর। এতে চাপ তৈরি হয় বাজেট বাস্তবায়নে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ মুুহূর্তে এসেও বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। বরং এ সংকট আরও বেড়েছে, যার ফলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে সংকট মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। বিদেশি ঋণের বোঝাও বেড়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এসব ঋণ পরিশোধ। যদিও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। ফলশ্রুতিতে অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আগামী অর্থবছরে এ সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকসহ কয়েকটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাস (জুলাই-মে) শেষে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। তিন খাত মিলিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৮৩.১০ শতাংশ অর্জন করেছে এনবিআর। যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। এনবিআর জানায়, চলতি অর্থবছরের মে ২৫ মাস পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪৬০.৪৫ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২.২৬ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৩.১০ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রাজস্ব আহরণের প্রভাব পড়েছে বাজেট বাস্তবায়নে। অর্থবছর শেষ হতে চললেও গতি নেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে।
১১ মাসে খরচের অগ্রগতি মাত্র ৪৯.০৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের চেয়ে এবার উন্নয়নে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ কম হয়েছে। জুন মাসে খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ মাসে ১ লাখ ১৫ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা খরচের টার্গেট রয়েছে, যা অসম্ভব মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, অর্থবছরের শেষ মাসে সরকারের যেমন এত টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য নেই, তেমন খরচেরও সামর্থ্য নেই। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে-জুলাই সময়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া যায়। অন্যদিকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশের অর্থনীতির ওপর এর একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তবে তারও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের মতোই আগামী বছরের জন্য কয়েকটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে অন্তর্বর্তী সরকারও। যেগুলোকে নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থসামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি অর্থবছর ২০২৫-২৬ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এখন সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। আগামীতে আরও সংকটের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা আছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে।
এ কারণে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সরকারের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে আছে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে আয় বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সঠিক খাতে কার্যকর করা, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া। কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করছে। এসব বিষয়ে অবশ্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি ও রাজস্ব খাতের সংস্কার। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেট পাস করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন পর্যন্ত কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যে মন্দা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঋণ পরিশোধের চাপসহ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা কারণ এ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ এসব সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু সংকটের প্রভাবে জনজীবনে যেসব আঘাত লেগেছে, সেগুলোর উপশম এখনও হচ্ছে না। এ জন্য সরকারকে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়াতে হবে, রাজস্ব আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পথ সুগম করতে হবে। সূত্র : দৈনিক সমকাল