
নিজস্ব প্রতিনিধি
৩১ জানুয়ারি, ২০২২, 1:58 PM

‘৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম, তবুও আমার ছেলেকে বাঁচতে দিল না’
‘ভিটে-মাটি বন্ধক দিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু, আমার ছেলেকে বাঁচতে দিল না। আমি ওসি প্রদীপের ফাঁসি চাই।’ এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় নিহত রিকশাচালক মো. আজিজের মা হালিমা খাতুন। তাঁর দাবি, পুলিশ তাঁর ছেলে আজিজকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর টেকনাফ মডেল থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। এরপর ভিটে-মাটি বন্ধক দিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন হালিমা। কিন্তু, ছেলের লাশটাই পান তিনি। আজিজ কক্সবাজারের টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা।
রিকশা চালিয়ে পরিবারের হাল ধরেছিলেন তিনি। কক্সবাজারের জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে আজ সোমবার মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ভুক্তভোগী ব্যক্তি, নিহতদের পরিবারসহ সাংবাদিকেরা ওসি প্রদীপের ফাঁসি চেয়ে মানববন্ধন করেন৷ মানববন্ধনে তাঁরা প্রদীপের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে শ্লোগান দিতে থাকেন। মানববন্ধনকারীদের দাবি, শুধু আজিজ নন, শত শত পরিবারের কাছে অর্থ চেয়ে না পেয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেন ওসি প্রদীপ। মানববন্ধনে মো. আজিজের মা হালিমা খাতুন ছেলের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলে রিকশা চালাত। ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর আজিজকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে আমি আজিজকে দেখতে যাই। সেখানে ওসি প্রদীপকে বলি, আমার ছেলেকে একবার দেখতে দাও। সে আমাকে গালি দিয়ে টাকা আনতে বলে। ২০ লাখ টাকা দাবি করে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর সহযোগীরা। নাহলে রাতে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়। আমার ছেলেকে জীবিত এক নজর দেখতে দিল না। ১৯ অক্টোবর রাতে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া নদীঘাট এলাকায় আজিজকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়।’ এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হালিমা খাতুন। হালিমা হাতুন আরও বলেন, ‘ভিটে-মাটি বন্ধক দিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছেলেকে বাঁচতে দিল না। আমি ওসি প্রদীপের ফাঁসি চাই।’ অপরদিকে, কক্সবাজারে বাবা-ছেলে নিহতের ঘটনায় তাঁদের পরিবারের অভিযোগ, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার চিংড়ি ব্যবসায়ী বাদশা ও তাঁর ছেলে সাদ্দাম হোসেন। ২০২০ সালে পৃথক ঘটনায় টেকনাফ থানা পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তাঁরা। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বাবা-ছেলেকে বন্দুকযুদ্ধের নামে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ হত্যা করেছিলেন। ওসি প্রদীপের দাবি করা ২০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে না পারায় বাবা-ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ পরিবারের। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ওসি প্রদীপ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করে ভুক্তভোগী পরিবার। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বীজ ও সার আনতে উপজেলা সদরের কৃষি অফিসে গিয়েছিলেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ। তাঁর পরিবারের দাবি, সেখান থেকে নূর মোহাম্মদকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। চাঁদা দিতে না পারায় ২১ মার্চ রাতে নূর মোহাম্মদকে সৈকতের ঝাউবাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল আলম খানের দাবি, ‘২০১৯ সালে ওসি প্রদীপের অপকর্ম নিয়ে নিউজ করেছিলাম। এ কারণে আমাকে ঢাকা থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছিলেন তিই। আমার চোখে মরিচের গুঁড়া দেয়, হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পানি চাইলে আমার মুখে প্রস্রাব করে দেয় প্রদীপ। এভাবে নয় মাস নির্যাতন, কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে আসি।’ ফরিদুলের দাবি, ‘আদালতের কাছে আমরা আবেদন করব, তাঁকে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়।’ এদিকে, বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় আজ কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল রায় ঘোষণা করবেন। দুপুরের পর রায় ঘোষণা করা হবে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন আদালতের ইন্সপেক্টর চন্দন কুমার দাশ। তিনি জানান, আসামিদের দুপুর ২টার দিকে আদালতে হাজির করা হবে। এরপর রায় ঘোষণা করা হবে। এরই মধ্যে রায়কে ঘিরে কক্সবাজার জেলা আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। আদালতের ফটকসহ সবদিকে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশন) সেলিম উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আদালতের চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল আলম তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। অন্যদিকে, বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বাদীপক্ষ।’ তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। এ মামলার ১৫ আসামি হলেন—টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী (৩১), টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ (৪৮), বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৬৫ জন ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দেন।সূত্র: এনটিভি