
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৫ মে, ২০২৫, 10:48 AM

নিজ অবস্থানে অনড় দলগুলো
তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ ও রোডম্যাপ চাইল বিএনপি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। অস্থিরতা নিরসনের লক্ষ্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিন দলই রয়েছে আগের অবস্থানে। এনসিপি এবার যুক্ত করেছে শেখ হাসিনার আমলের সব নির্বাচন বাতিলের দাবি
সরকারের পদত্যাগের আলোচনায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং গুঞ্জনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। গতকাল শনিবার যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলটি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে রোডম্যাপ ঘোষণা এবং দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানায়। দাবির জবাবে সরকারের বক্তব্য পায়নি বিএনপি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন, সংস্কার, বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন বিএনপি নেতারা। আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি জানান তারা।
তিন পৃষ্ঠার চিঠিতে বিএনপি দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে। আদালতের রায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ পাওয়া ইশরাক হোসেনের শপথ গ্রহণের বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে এতে আশা প্রকাশ করা হয়।
শপথ না দিয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার পাশে ছিলেন আসিফ মাহমুদ। তাঁর উপস্থিতিতে বিএনপি লিখিত বক্তব্যে বলে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে– এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।’
বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। অথচ আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তিই ঐক্য। সরকারের কিছু কাজে নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মানবিক করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ডে জাতীয় স্বার্থে রক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অস্থায়ী সরকারের আছে বলে জনগণ মনে করে না।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, যে উপদেষ্টারা নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত বলে সবাই জানে ও বুঝে; তারা সরকারের নির্দলীয়-নিরপেক্ষ পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘সংস্কার সনদ’ তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে এনসিপির নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচিকে বিএনপি এবং সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইনানুযায়ী গঠিত কমিশনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন। এমতাবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে কমিশন ঘেরাও উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক। যেসব বক্তব্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো ‘আগের মতোই’ আমলে না নিলে বিএনপি সরকারকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিতে নিরুৎসাহিত হবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের কথা আমরা লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছি। আগেও জানিয়েছি। যাদের কারণে এই সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তাদের বাদ দেওয়ার জন্য মুখেও বলেছি।’
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে রোডম্যাপ ও অন্যান্য দাবির বিষয়ে আশ্বাস পেয়েছেন কিনা– জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তারা কথা শুনেছেন। এখন তাদের কোনো বক্তব্য থাকলে সংবাদমাধ্যম দিয়ে পুরো জাতিকে জানাবেন। আমরা আমাদের বক্তব্য দিয়েছি।’
নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে এই রকমের কোনো কথা হয়নি। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাননি। আমরা আমাদের দাবি জানিয়েছি। হয়তোবা উনারা প্রেসের মাধ্যমে জানাবেন। সেজন্য অপেক্ষা করব। এখনই কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রয়োজন নেই। সংবাদমাধ্যমকে তারা কী বলেন, তা শুনে আমরা প্রতিক্রিয়া দেব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচনের আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের বিষয় ঠিক করবে। তা চলমান থাকবে। যদি ভবিষ্যতে জনগণ ক্ষমতায় বসায় বিএনপিকে, সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে চেষ্টা করবে।
মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে স্বৈরাচার ফেরার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর দায়দায়িত্ব বর্তমান সরকার এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপরে বর্তাবে। মানুষ বিশ্বাস করে, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি প্রথম থেকেই সুস্পষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে। বিএনপির প্রত্যেক নেতাকর্মী পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ জন্য আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি সবচেয়ে বেশি জানিয়েছে বিএনপি। বিচার প্রক্রিয়া কোনোভাবে অসম্পন্ন থাকলে বিএনপি সরকারে গেলে স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে। তিনি আরও বলেন, তারা কখনোই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাননি, বরং প্রথম দিন থেকেই এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে বিএনপি।
বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সূত্র : সমকাল