
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৬ এপ্রিল, ২০২২, 10:21 AM

দ্রব্যমূল্য ও ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে উত্তপ্ত সংসদ
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে গতকাল সরব ছিলেন বিরোধী দলের এমপিরা। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতায় বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমপিরা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও প্যানেল স্পিকার শহীদুজ্জামান সরকারের সভাপতিত্বে গতকাল সংসদের ১৭তম অধিবেশনের বৈঠকে পৃথক দুটি বিলের ওপর আলোচনার সময় বিরোধী দলের এমপিরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদে উপস্থিত ছিলেন। সংসদে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হচ্ছে না : সংসদে ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিলটি পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিলটিতে সংসদীয় কমিটির একটি নতুন ধারা অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় পার্টির এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি সংসদীয় কমিটি বিলে নতুন ধারা যুক্ত করতে পারে কি না, সে বিষয়ে স্পিকারের রুলিং চান। স্পিকার এ বিষয়ে জবাব দিতে মন্ত্রীকে ফ্লোর দেন। নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ এ সময় সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। পরে বিলের ওপর সংশোধনী প্রস্তাব আনার সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু ‘সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ও এখতিয়ার’ প্রসঙ্গে সংসদে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে ততক্ষণ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা নেই। বাজেটে সংসদ সদস্যদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। স্বাধীনভাবে বলার সুযোগ নেই।’ জাতীয় পার্টির মহাসচিব আরও বলেন, ‘সংসদের কি খুব একটা ক্ষমতা আছে? যিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা তার হাতেই সব ক্ষমতা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কারও কিছু বলার ক্ষমতা আছে? বললে কি সদস্য পদ থাকবে?’ এ বিষয়ে বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা কতটুকু আছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’
ব্যবসায়ী হওয়া কি অপরাধ? : দ্রব্যমূল্য নিয়ে বারবার বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি শেষ পর্যন্ত আক্ষেপ করে সংসদে বলেন, ব্যবসায়ী হওয়া কি তাঁর অপরাধ? তিনি বলেন, ব্যবসা করি আজকে ৪০ বছর, রাজনীতি করি ৫৬ বছর। ৬৬ সাল থেকে শুরু করেছি কিন্তু রাজনীতিবিদ হতে পারিনি। টিপু মুনশি আরও বলেন, যুদ্ধের কারণে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, এটা তিনি কখনো বলেননি। প্রতি মাসে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। এখন বিশ্ব বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত ফলোআপ করছেন।
সংসদে ক্ষোভের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী : একটি বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের স্বার্থে এই বিলটি আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে সিন্ডিকেটকে উৎসাহী করা হচ্ছে। সিন্ডিকেট নিয়ে বিএনপির এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হইচই হলো। ১৫ দিনে সিন্ডিকেট ১ হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। সিন্ডিকেট হলো সরকার। সরকার আর সিন্ডিকেটের মধ্যে পার্থক্য নেই।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, গ্যাসের অভাবে ঢাকায় হাহাকার চলছে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম সব বাড়ানো হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার অভাব আছে। বিএনপি করে বলে অনেকে বিসিএসে উত্তীর্ণ হচ্ছে না : জাতীয় সংসদে সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য নিরোধে নতুন আইন তোলার বিরোধিতা করে বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, বৈষম্য বিরোধী বিলের ‘কী প্রয়োজন পড়েছে তা বুঝতে পারছি না’। তিনি বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই। গুম, খুনের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিএনপি করে দেখে চাকরি হচ্ছে না। এখানে রাষ্ট্র বৈষম্য করছে, রাষ্ট্র বৈষম্য করলে কী হবে সেটি বিলে বলা নেই।’ উনার কাছ থেকে আমার মানবাধিকারের শিক্ষা নিতে হবে না : বিলটি উত্থাপনে বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদের জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, উনার কাছ থেকে আমার মানবাধিকারের শিক্ষা নিতে হবে না। আমার মানবাধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। উনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন সময় হলে অবশ্যই জবাব দেব। বাসা ভাড়ায় বৈষম্য হলে আদালতে যাওয়ার বিধান রেখে বিল : সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য নিরোধে সংসদে নতুন বিল তোলা হয়েছে। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব ধরনের বৈষম্য নিরোধে এই খসড়া আইন করা হয়েছে। গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘বৈষম্য বিরোধী বিল-২০২২’ সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলে বলা হয়েছে, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের অধীনে একটি বৈষম্য বিরোধী সেল থাকবে। বৈষম্য বিরোধী জাতীয় ও স্থানীয় কমিটি গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছে। জাতীয় কমিটি যদি প্রতিকার করতে না পারে তবে আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে। বিলে বলা হয়েছে, দেওয়ানি কার্যবিধিতে যাই থাকুক না কেন মামলা দায়েরের পর ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন সময় পাবে আদালত। বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সর্বসাধারণের স্থলে প্রবেশ বা উপস্থিতিতে বাধা প্রদান, নিয়ন্ত্রণ অথবা সীমাবদ্ধতা আরোপ করা; সরকারি আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি অফিসের সেবা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত করা; কোনো পণ্য বা সেবা আইনানুগভাবে উৎপাদন, বিক্রয় অথবা বিপণন করতে বাধা দেওয়া বা আইনে নির্ধারিত কোনো সুবিধা বা পণ্য বা সেবা গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতা আরোপ করা; উপযুক্ত কারণ ব্যতীত পিতা-মাতার পরিচয় প্রদানে অসমর্থতার কারণে কোনো শিশুকে ?শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি বা অমত বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা বাধা দেওয়া বা সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান বা অবস্থানের ক্ষেত্রে পার্থক্য, বঞ্চনা, বিধি-নিষেধ আরোপ, সীমাবদ্ধকরণ, শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার বা অন্য যে কোনো ধরনের বৈষম্য করা; প্রতিবন্ধী বা তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ার কারণে কোনো শিশুকে পরিবারে প্রতিপালন না করে বিশেষ কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা বা প্রতিবন্ধিতার অজুহাতে পরিবারে বসবাসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তা বৈষম্যমূলক কাজ বলে গণ্য হবে।