ঢাকা ২১ জুন, ২০২৫
সংবাদ শিরোনাম
গলে ড্র দিয়ে টেস্টের নতুন চক্র শুরু করল বাংলাদেশ নোয়াখালী মানব কল্যাণ পরিষদ, ইন ফ্রান্স-এর ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ২০২৫ একদিনে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১ ইরানে হামলায় এ পর্যন্ত নিহত ৪৩০ : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের পরিচয় মিলেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ঢাকা মেডিকেল কলেজ পাঁচদিন টানা বৃষ্টির আভাস মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দেশ: উপদেষ্টা সাখাওয়াত আ. লীগকে নিষিদ্ধ করিনি, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা সিদ্ধান্ত ইসির: বিবিসিকে প্রধান উপদেষ্টা ছাগলনাইয়ায় সেফটিক ট্যাংক থেকে দুই শিশুর লাশ উদ্ধার

বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস আজ

#

স্বাস্থ্য ডেস্ক

১২ নভেম্বর, ২০২২,  10:35 AM

news image

তিন মাসের শিশু সায়েমা মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছে। তার হাতে লাগানো ক্যানলা আর নাকে স্যালাইনের নল। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১১ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ২০৮ নম্বর রুমে ভর্তি। কিছু সময় পরপরই শিশুটির মা খুকি বেগম চিৎকার করে করে ছুটেছেন নার্সদের কাছে। আর করুণ চোখে সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছেন অসহায় বাবা নাসির হোসেন।  শিশুটির মা জানান, আমার বাচ্চাটি বুকের দুধ খাচ্ছে না। শুধু স্যালাইন চলছে। কিছুক্ষণ পরপর কান্না করে। বাচ্চার এই করুণ অবস্থা আর সহ্য করতে পারছি না। শুধু খুকি বেগম নয়, এমন দৃশ্য (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডজুড়েই। স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকায় বারান্দা ও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে শিশুদে র। আর শীত আসার আগেই নিউমোনিয়া, ঠান্ডা-জ্বর, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। চিকিৎসকরা বলেছেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হলো নিউমোনিয়া। আর বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ২৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১২ নভেম্বর পালিত হবে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস-২০২২। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি পালন করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে নিউমোনিয়া চিকিৎসায় সম্প্রসারিত টিকাসহ নানা কর্মসূচি থাকলেও বায়ুদূষণ, অসচেতনতা, নিরাপদ পানির সংকট ও অপুষ্টি এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ফুফফুস সংক্রমণজনিত রোগ নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। শুক্রবার (১১ নভেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড হাসপাতাল) এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই বাড়ছে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া-বমি, সর্দি-কাশিসহ নানা ধরনের ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব। এসবের মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যাই বেশি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আবহাওয়াজনিত কারণে বাড়ছে শিশু রোগীর সংখ্যা। বেশিরভাগ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। ঢামেক শিশু ওয়ার্ডের ২০৮ নং রুমে কয়েকজনকে দেখা গেল নিউমোনিয়া আক্রান্ত বাচ্চাকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের একজন তানিয়া বেগম। তিনি জানান, তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। এখানে তার শিশু সন্তান ত্বোহাকে আট দিন আগে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ায় মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। ঠান্ডা-জ¦রে তার বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। একই ওয়ার্ডে পাঁচ দিন ধরে ভর্তি ইসা সরকারকে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে তার মা ডলি রানি। তিনি জানান, এখানে ভর্তির পর প্রথম দিন কোনো ডাক্তারই আসেননি। এক দিন আমার বাচ্চার চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু এখনও বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ। আমরা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। এই ওয়ার্ডের এক নার্স জানান, এখানে ৩০ জন শিশু ভর্তি আছে। কিন্তু শয্যা রয়েছে ১৪টি। রোগীদের মধ্যে ১১ জনই ঠান্ডাজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালের আর তিনটি শিশু ওর্য়াড ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে শিশুরা বেশি আসছে নিউমোনিয়া, হাঁপানি এবং সাধারণ সর্দি-কাশি নিয়ে। এই ব্যাপারে ঢামেকের শিশু বিভাগের চিকিৎসক ডা. আল-জাবির সময়ের আলোকে বলেন, শীতের কারণে মৌসুমি রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের যেন ঠান্ডা না লাগে সেদিকে নজর দিতে হবে। আর শিশুকে ধুলা-বালি, চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল এবং কল-কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে নিউমোনিয়া রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।তিনি বলেন, আমরা অনেকেই জানি না নিউমোনিয়া রোগের ভ্যাক্সিন বিদ্যমান। বিশেষ করে পাঁচ বছরের নিচে বা ৬৫ বছরের ওপরে বয়সিদের অথবা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন নেওয়া জরুরি। আর ধূমপান এবং মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। কারণ, ধূমপান ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। ফলে সহজেই সংক্রমণ ঘটতে পারে এবং নিউমোনিয়া হতে পারে। ধূমপায়ীদের নিউমোনিয়া সহজেই জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকা শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, রোগীর চাপ বাড়ায় এখানকার ৬৮০টি শয্যার একটিও বর্তমানে ফাঁকা নেই। এর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), নবজাতক নিবিড় যত্ন ইউনিট (এনআইসিইউ), পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক শিশু রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন থাকলেও ফাঁকা না, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিতে পারছে না। হাসপাতালের একাধিক নার্স জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় গত দুই সপ্তাহে প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ২০০ রোগী বেশি আসছে। এর মধ্যে দুই মাস বয়সি শিশু বেশি। হাসপাতালের নিচ তলার এক নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসক ও একজন নার্স চার মাস বয়সি শিশু ইফতাদ হোসেনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। শিশুটিকে নিয়ে আসা হয়েছে রাজধানীর তেজঁগাও থেকে। তার মা ফাতেমা বেগম জানান, বুধবার সকালে হঠাৎ শিশুটির শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। প্রথমে শিশুটিকে নেবুলাইজার দেওয়া হয়। তাতেও শ্বাসকষ্ট না কমায় দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আইসিইউতে নিতে হবে, কিন্তু ফাঁকা না থাকায় নিতে পারছি না। ঢাকা শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামন কামরুল সময়ের আলোকে বলেন, দেশে এখনও শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। যদিও শিশুদের জন্মের ৬ সপ্তাহের মধ্যে টিকা নেওয়ার কারণে মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। কারণ রোগটির চিকিৎসায় বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ উপজেলা পর্যায়েও শিশু চিকিৎসক রয়েছেন। তাই নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আরও সচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে। তিনি বলেন, কিছু দিন আগেও আবহাওয়া গরম ছিল, কিন্তু এখন শেষ রাতে শীত পড়ছে। ফলে বাচ্চারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আর বাচ্চাদের সর্দি-কাশি হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরার্মশ নিতে বলেন এই চিকিৎসক। গত বুধবার রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উপলক্ষে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যা রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি (হাইপক্সেমিয়া)। সারা বিশ্বে প্রতি বছর সাত কোটি ৩০ লাখ মারাত্মক অক্সিজেন ঘাটতিতে ভোগেন। যার মধ্যে শিশুই তিন কোটি ২০ লাখ। আর দেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামো অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিউমোনিয়া নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশই হাইপক্সেমিয়ায় ভোগে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআর,বির মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানুর রহমান। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমাদের ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি এক হাজার জীবিত-জন্ম শিশুর মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৩-এ নামিয়ে আনতে হবে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, দেশে প্রতি বছর এখনও এক হাজার জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে পাঁচ বছর বয়সের আগেই ৩ শতাংশ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ফলে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর শিশুরা রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতায় বেশি মারা যাচ্ছে। তাই অক্সিজেনের ঘাটতি কমাতে হবে এবং প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পালস অক্সিমিটার থাকা জরুরি। এ ছাড়াও শিশু মৃত্যু হার কমাতে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে এবং শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

logo

সম্পাদক ও প্রকাশক : মো. নজরুল ইসলাম