
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৫ জুন, ২০২৫, 11:12 AM

ঢাকার গণপরিবহনে ৪৯ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরী ও দূরপাল্লায় চলাচলকারী বাসের ভাড়া বাড়াতে চাচ্ছেন মালিকরা। এক্ষেত্রে মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৬০ পয়সা করার প্রস্তাব জানানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রস্তাবে বাসের ভাড়া ৪৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। মহানগরের পাশাপাশি দূরপাল্লার গন্তব্যেও বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪৫ পয়সার ভাড়া বাড়িয়ে ৩ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দূরপাল্লার বাসে ভাড়া ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানিয়ে গত ২১ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। চিঠিতে ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হলেও নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। এতে ‘যৌক্তিক হারে’ ভাড়া বাড়ানোর কথা বলা হয়।
কিন্তু মৌখিকভাবে মহানগরীতে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ১৮ পয়সা ও দূরপাল্লায় ৫০ পয়সা করে বাড়ানোর কথা সরকার সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়। এটি পরিবহন মালিক সমিতি ও মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের দায়িত্বশীল সূত্রই কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে।
কথা হলে গত ২১ জুন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ‘বাসের ভাড়া বাড়ার প্রস্তাব নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছি; কিন্তু এখনো আমাদের দিক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
ভাড়া বাড়ানোর এ প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘ঢাকার ও দূরপাল্লার পরিবহনের ভাড়া এত কাছাকাছি হওয়ার কোনো কারণ নেই। আগের সমিতির নেতাদের দূরপাল্লায় বাস বেশি ছিল, তাই সেখানে তাদের স্বার্থ ছিল। আমরা সরকারকে ঢাকাসহ মহানগরগুলোয় ৩ টাকা ৬০ পয়সা ও দূরপাল্লায় ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ৩ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছি।’
কী আছে সরকারকে দেওয়া সেই চিঠিতে : ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর নেতৃত্বে গত ২১ জানুয়ারি ঢাকায় আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সভায় বাস ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা ওঠে। ওই সভায় সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। তারপর দাবি জানিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়। যে চিঠিতে বলা হয়, ‘২০২২ সালের ৬ আগস্ট ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় শুধু ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ভিত্তিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২ দশমিক ২০ টাকা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া যথাক্রমে ২ দশমিক ৪০ টাকা ও ২ দশমিক ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ওই সময় গাড়ির টায়ার-টিউব, লুব্রিকেন্ট, ব্রেক-সু এবং অন্যান্য খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, ট্রাক, পিকআপ, মিনি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইমমুভারের (পণ্যবাহী যান) ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব যানবাহনের ভাড়া সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা হয়নি।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ডলারের মূল্য ৮২ থেকে ১২৩ টাকা হয়েছে। টায়ার-টিউব, লুব্রিকেন্ট, ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি, ব্রেক-সুসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রাংশের মূল্য ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। মালিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘ভাড়া না বাড়ালে গাড়ি চালানো কঠিন হয়ে যাবে। সব কিছুর দাম বাড়ছে, বাস ভাড়া কেন বাড়বে না। আর যদি বাসের ভাড়া বাড়ানো না হয়, তাহলে যন্ত্রাংশের দাম কমাতে বলব।’
ভাড়া বাড়ানোর যৌক্তিকতা কী: সাধারণত বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানির মূল্য, গাড়ির দাম, যদি ব্যাংক ঋণ থাকে তাহলে সুদের হার, যন্ত্রাংশের মূল্য এবং গাড়ির মানসহ মোট ১৭টি খাত বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বাসের অন্তত ৩০ শতাংশ যাত্রী শূন্য থাকবে ধরে নিয়ে ভাড়া ঠিক করা হয়। যেন সব আসনে যাত্রী না থাকলেও মালিকের লোকসান না হয়। মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সর্বশেষ ভাড়া বাড়ানোর সময় শুধু জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যান্য খাত গুরুত্ব পায়নি। এখন যন্ত্রাংশের দাম বাড়ছে।
তবে এ মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক কারণ দেখছেন না বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আগের তুলনায় তেলের দাম আরও কমেছে। চাইলে ভাড়া কমানো যায়। আর ঢাকায় চালাচলকারী বাজে মানের বাসগুলোর ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্নই উঠে না। ভালো বাস নামালে, যাত্রীদের ভালো সেবা দেওয়া হলে সরকার তখন ভাবতে পারে।’
এদিকে ২০২২ সালে ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়ায় বাস ভাড়া ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এখন ডিজেলের দাম ১২ টাকা কমেছে। অঙ্কের হিসাবে ভাড়া ১৪ পয়সা কমার কথা। যদিও এ সময়ের মধ্যে দুই দফায় ৩ পয়সা ও ৫ পয়সা ভাড়া কমানো হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, ‘শুধু তেলের দামের ওপর ভাড়া ঠিক করা হয় না। গত আড়াই বছরে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। অথচ এ সময়ের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে। এখন ৫ বা ১০ টাকায় কী পাওয়া যায়! এ ছাড়া ঢাকায় যানজটের কারণে স্বাভাবিক হিসেবের দেড় গুণ তেল লাগে। বাসের ভাড়া যৌক্তিকভাবে পুনঃনির্ধারণ না করলে মালিকদের টিকে থাকা কঠিন হবে।’সূত্র : দৈনিক কালবেলা