
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৯ মার্চ, ২০২২, 10:42 AM

ঝুঁকিতে রুশ নাগরিকদের ‘নিরাপদ-স্বর্গ’ তুরস্ক
ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নির্বিচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলো। এতে অন্তত একজন অলিগার্ক থেকে শুরু করে হাজার হাজার রুশ নাগরিক তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। থাকা, বিনিয়োগ করা ও সম্পদ রাখার জন্য দেশটিকে তাদের কাছে নিরাপদ বলে মনে হয়েছে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হলেও সেখানে নিজেদের অর্থনৈতিক তৎপরতা চালাতে কোনো ধরনের বিপদ অনুভব করছেন না তারা। তবে নিষেধাজ্ঞা কবলিতদের জন্য নিরাপদ-স্বর্গে পরিণত হওয়ায় তুরস্ক সরকার, ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্যও ঝুঁকি আছে। কারণ মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তৃতীয় পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাড়াতে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলো।-খবর রয়টার্সের
কেন রুশদের জন্য তুরস্ক আকর্ষণীয়?
প্রতিবেশী দেশে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অভিযানকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়েছে তুরস্ক। কিন্তু নীতিগতভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞারও বিরোধিতা করেছে। তুরস্ক বলছে, তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে না। মুদ্রা সংকটের কারণে তুরস্কের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছে। তেল, গ্যাস, বাণিজ্য ও পর্যটনে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল তুরস্ক। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার রুশ নাগরিক তুরস্কে এসেছেন। মার্কিন ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের কাছে ছিল তোড়ায় তোড়ায় নগদ অর্থ। তুরস্কে নিরাপদ বিনিয়োগে রুশ নাগরিকদের কেউ কেউ সম্পত্তি কিনতে ক্রিপ্টো কারেন্সি ও নগদ অর্থ ব্যবহার করেছেন। মার্কিন কালোতালিকায় থাকা রুশ অলিগার্ক রোমান আব্রামোভিচও দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন। গত সপ্তাহে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার দামের তার দুটি প্রমোদতরী তুরস্কের রিসোর্টে নোঙর করা ছিল। সূত্রের বরাতে রয়টার্স বলছে, অলিগার্করা সেখানে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন। এরআগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগলু বলেন, অলিগার্কসহ রুশ নাগরিকদের অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে তারা ব্যবসাও করতে পারবেন।
তুরস্কই কী তাদের শেষ নিরাপদ-স্বর্গ?
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন অলিগার্কের সম্পদ জব্দ করেছে পশ্চিমাশক্তিগুলো। তাদের বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ হয়েছে। সুইফট ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছে রুশদের। আশঙ্কা হচ্ছে, অলিগার্করা যাতে তুরস্কে ঢুকতে না পারেন, তা নিশ্চিতে আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে তুরস্ককে চাপ দিতে পারে পশ্চিমারা। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করা তৃতীয়পক্ষগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইস্তানবুলভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার হাকান আকবাস বলেন, যদি মানবিক বিপর্যয় তীব্র হয়ে ওঠে, প্রেসিডেন্ট পুতিনও নিজের অবস্থান থেকে সরে না আসেন, তখন তৃতীয়পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অপরিহার্য হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, কোনো দেশই যাতে রুশ নাগরিকদের জন্য নিরাপদ-স্বর্গ হতে না পারে, পশ্চিমারা সেদিকেই বেশি নজর দিতে পারেন। আংকারার হাত শক্ত করে বাঁধা হবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া তখন অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে। এরমধ্য দিয়ে তুরস্কের ব্যাংক ও কোম্পানিগুলোকে শীতল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এতে রাশিয়ার নাগরিকদের সঙ্গে লেনদেন কিংবা বিদেশে কারবার করতে তারা নিরুৎসাহিত হবে। ২০২০ সালে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প অধিদফতর ও এটির প্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়। রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয় করার দায়ে তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে তুরস্ক। ইতিমধ্যে আলোচনায় বসতে ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা ইস্তানবুলে পা রেখেছেন। যে কারণে তুরস্ক নিষেধাজ্ঞার ক্রসফায়ার থেকে রেহাই পেতে পারে। আংকারার কূটনৈতিক ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট। সঙ্গেও এও বলেন, তুরস্ক যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করে, তবে আরও খুশি হবেন।
ব্যাংক ও কোম্পানিগুলো কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে?
বিপুল রুশ গ্রাহকদের পেলেও তাদের কিছু কিছু আমানত ও অর্থ হস্তান্তরে বাধা দিচ্ছে তুরস্কের ব্যাংকগুলো। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হতে তারা চেকগুলোকে অনেক বেশি যাচাই-বাছাই করছেন। এতে কিছু কিছু রুশ নাগরিক হতাশ হচ্ছেন। কিন্তু এসব কার্যক্রমে তুরস্কের আর্থিক খাতগুলোর ব্যাপক সতর্কতারই প্রতিফলন ঘটছে। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হালকব্যাংক যেভাবে কয়েক বছর ধরে মার্কিন সাজার মুখে আছে, তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে চায় না অন্যরা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে ইরানকে সহায়তা করার অভিযোগ তোলা হয়েছিল হালকব্যাংকের বিরুদ্ধে। বিডিডিকে ব্যাংক নিয়ন্ত্রক বলছে, কোনো দেশের নাগরিকের আর্থিক কার্যক্রম সীমিত করে দিতে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কিন্তু একটি ব্যাংকিং সূত্র বলছে, নিষেধাজ্ঞাকে নতুন ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আলোচনা করতে ফার্মগুলো কয়েকবার বৈঠক করেছে। আকবাস বলেন, রাশিয়ায় তুরস্কের বড় বড় কোম্পানি ও কনগ্লুমারেটের এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ রয়েছে। এগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে রাশিয়া। কর্মীদের বেতন দেওয়া ও দেউলিয়ার ঝুঁকি রয়েছে তাদের। এসব কোম্পানির অনেকগুলো পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক বেশি ব্যবসা করে। এখন রাশিয়ায় তারা ব্যবসা করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। চলতি সময়ে তুরস্ক যদি কোনো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেশটির ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।