
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৬ এপ্রিল, ২০২২, 2:44 PM

ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞায় তেলের মূল্য আকাশছোঁয়া
বিশ্বজুড়ে ভোজ্য তেলের মূল্য বেড়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। পাম তেল রফতানিতে হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। এতে রান্নার তেলের দাম যেন বাঁধনহারা গতিতে ছুটছে। পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা শঙ্কা চরম রূপ নিয়েছে। শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো পাম তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। বেশ কয়েকটি দেশে এবার ফসল উৎপাদন ছিল হতাশাজনক। এতে খাদ্য সরবরাহে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। খবর রয়টার্স ও আলজাজিরার বৈশ্বিক ভোজ্য তেলের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে পাম তেল থেকে। দক্ষিণ আমেরিকায় অনাবৃষ্টিতে সয়াবিন, কানাডায় ক্যানোলা ফসলের বিপর্যয়ে সরিষা ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। গেল ছয় মাসে ভোজ্য তেলের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। আবার মালয়েশিয়ায় শ্রম ঘাটতি, আর্জেন্টিনা ও কানাডায় অনাবৃষ্টিতে ভোজ্য তেলের সরবরাহ কমে এসেছে।
সয়াবিন ও ক্যানোলার সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ কানাডা ও আর্জেন্টিনা। ইউক্রেনে সূর্যমুখীর বাম্পার ফলনে ক্রেতাদের মধ্যে আশা জাগালেও রাশিয়ার অভিযানে তাতে গুড়েবালি পড়েছে। যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগর হয়ে এই রফতানি বন্ধ রয়েছে। সোমবার বুসরা মালয়েশিয়ার ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জে পাম তেলের মূল্য বেড়েছে ছয় শতাংশের বেশি। গত মার্চে দাম বেড়ে রেকর্ড স্পর্শ করতে যাচ্ছিল। আবার সেই গতি ঊর্ধ্বমুখী নিয়েছে। হংকংভিত্তিক অর্থনীতিবিদ ত্রিনহ নাগোয়েন বলেন, বিশ্বে পাম তেলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া। তারা যখন এই তেল রফতানি বন্ধ করে দেয়, তখন ভোজ্য তেলের সরবরাহে বড় ধাক্কা লাগাই স্বাভাবিক। এতে সর্বোচ্চ মূল্য বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা বেশি ঝুঁকিতে, খাদ্যমূলের চাপ তাদেরই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভারতের মতো যেসব দেশের অনেক বেশি খাদ্য চাহিদা, তাদের বিপদ বাড়বে। ইন্দোনেশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহৎ পাম তেল উৎপাদনকারী মালয়েশিয়া। কিন্তু করোনা মহামারিতে দেশটি ব্যাপক শ্রম ঘাটতির মুখে পড়েছে। ত্রিনহ নাগোয়েনের মতে, পাম তেলের দাম বাড়ায় মালয়েশিয়ার লাভ হলেও সরবরাহ ঘাটতি পূরণে সক্ষম হবে না। এতে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যে প্রভাব পড়বে। গেল কয়েক মাস ধরেই অপরিশোধিত পাম তেলের মূল্য আকস্মিক বাড়ছে। জানুয়ারিতে পাম তেল রফতানি সীমিত করে দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। পরে মার্চে তা শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রান্নার তেলের জন্য নাগরিকদের নগদ অর্থ সহায়তারও ঘোষণা দিয়েছেন জোকো উইদোদো। শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যপণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পাম তেলের রফতানি বন্ধ অপরিহার্য ছিল। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম বাড়ছে। দেশের ভেতরে সেই প্রবণতার লাগাম ধরতে এই সিদ্ধান্তের বিকল্প ছিল না। রফতানি নিষেধাজ্ঞা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না; তা নিশ্চিত করতে মনিটরিং করা হবে বলেও জানান ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। ২৮ এপ্রিল থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে। তবে কতদিন তা স্থায়ী হবে, সেই আভাস দেওয়া হয়নি। এরপর সয়াবিন তেলের মূল্যও সাড়ে চার শতাংশ বেড়েছে। পাম তেলের পরেই এটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্য তেল। এদিকে যুক্তরাজ্যের অনেক বিপণিবিতান ঘোষণা দিয়েছে-তারা অলিভ, সূর্যমুখী ও সরিষার তেলের বিক্রি ক্রেতাপ্রতি দুই কিংবা তিনটি আইটেমের মধ্যে সীমিত করে দেবে। সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রধান অর্থনীতিবিদ টিম হারকোট বলেন, ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল নিষেধাজ্ঞায় রফতানি ও আমদানিকারকরাও লোকসানে পড়বেন। এতে বাণিজ্য ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার জন্যও তা ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন আটকে যাবে এবং বিশ্বজুড়ে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্দোনেশিয়ার ওপর বৈশ্বিক আস্থা কমে যাবে। দেশটির কাছ থেকে যারা পাম তেল কেনেন, তাদের সঙ্গেও সম্পর্কে ফাটল দেখা দেবে। বহু দেশ পাম তেলের জন্য ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভর করছে। ফলে দেশটির বাণিজ্যিক অংশীদাররা পড়ে যাবেন অনিশ্চয়তায়। দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। কারণ ক্রেতারা আর জাকার্তার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন না। রান্না ছাড়াও চকোলেট থেকে শুরু করে প্রসাধনীসহ বিভিন্ন মোড়কজাত পণ্য উৎপাদনে পাম তেল ব্যবহার করা হয়। যে কারণে চলমান সংকটে সব ধরনের পণ্যের মূল্য বেড়ে পরিবারগুলো অতিরিক্ত চাপে পড়ে যাবে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় ভোক্তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে জাকার্তা সঠিক কাজটিই করেছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্থার বিশ্লেষক আগুস ইকো নুগরোহো বলেন—আমি মনে করি না, এই নিষেধাজ্ঞা হঠাৎ করে এসেছে। কারণ অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকারের একটা বাধ্যবাধকতা আছে। এখানে সরবরাহ নিশ্চিত রাখাও সরকারের দায়িত্ব।